উত্তরপত্র কারসাজি করে ফল পাল্টে দেয়ার অভিযোগ ছিল মুস্তারী জাহান নামের রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের এক পরীক্ষার্থীর। ১৬ বছর আগের ঘটনায় এ নিয়ে মামলা করেন ওই পরীক্ষার্থীর বাবা।
আদালত ওই পরীক্ষার্থীর পক্ষে রায় দিলে শিক্ষাবোর্ড উচ্চ আদালতে যায়। সেখান থেকে মামলাটি আবারও ফিরে আসে নিম্ন আদালতে। এ ঘটনায় তিন কোটি ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে বাদীপক্ষ।
ভুক্তভোগী মুস্তারী জাহান বাঘা উপজেলার তেঁথুলিয়া গ্রামের মুনসুর রহমানের মেয়ে। ২০০৪ সালে তেঁথুলিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেন মুস্তারী।
২০০৪ সালের ২৬ জুন এসএসসির ফল প্রকাশিত হয়। ওই পরীক্ষায় মুস্তারীকে অকৃতকার্য দেখানো হয়। পরে মুস্তারী খাতা পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করেন। তাতেও কাঙ্ক্ষিত ফল না পেয়ে ১ নভেম্বর রাজশাহী আদালতে মামলা করা হয়।
ওই সময় অপ্রাপ্তবয়স্ক থাকায় তার পক্ষে আদালতে মামলা করেন বাবা মুনসুর। ওই মামলায় বিবাদী করা হয় রাজশাহী শিক্ষাবোর্ড, বোর্ডের চেয়ারম্যান, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও পরীক্ষা কেন্দ্রের সচিবকে। আগামী ১ নভেম্বর মামলাটি ১৭ বছরে পড়বে। আগামী বছরের ২০ জানুয়ারি মামলার পরবর্তী দিন ধার্য রয়েছে।
মামলার আরজিতে উল্লেখ করা হয়, মুস্তারী বিদ্যালয়ের নির্বাচনী পরীক্ষায় ৮৭ শতাংশ নম্বর পেয়ে পাস করেন। ওপরের কভার ঠিক রেখে উত্তরপত্র বদল করার কারণে তার ফলাফল অকৃতকার্য এসেছে।
মুস্তারীর বাবা মুনসুর রহমান বলেন, মামলাটি আমলে নিয়ে শিক্ষাবোর্ডকে আদালত উত্তরপত্র হাজির করার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত উত্তরপত্র নষ্ট না করার ব্যাপারেও আদেশ দেন আদালত। আদালতের নির্দেশে ট্রাঙ্ক ও তালাচাবি কেনার জন্য নির্ধারিত ফি জমা দেই।
ওই আদেশের বিরুদ্ধে শিক্ষাবোর্ড হাইকোর্টে সিভিল রিভিশন করে। সেখানেও নিম্ন আদালতের আদেশ বহাল রাখা হয়। পরে শিক্ষাবোর্ড আপিল বিভাগে যায়। ২০০৯ সালের ১২ মার্চ আপিল বিভাগ নিম্ন আদালতের আদেশ বহাল রেখে উত্তরপত্র হাজিরের নির্দেশ দেন।
মামলার সাত বছর পর ২০১১ সালে শিক্ষাবোর্ড আদালতকে জানায়, ছয় মাসের বেশি শিক্ষাবোর্ডে উত্তরপত্র সংরক্ষণ করা হয় না। এ শিক্ষার্থীর খাতার ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলেনি শিক্ষাবোর্ড।
ফলে ২০১১ সালের ২১ জুন বোর্ডের চেয়ারম্যানকে পরবর্তী ধার্য দিনে সশরীরে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন আদালত। চেয়ারম্যান সশরীরে হাজির হতে পাঁচ বছর সময় নেন। তার পরও খাতা দেখানো হয়নি। এ নিয়ে বাদীপক্ষ তিন কোটি ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে। বর্তমানে ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে মামলাটি নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
এদিকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর মামলার বাদী হন মুস্তারী জাহান। তিনি বলেন, চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে পড়াশোনা করছিলাম। কিন্তু আমার শিক্ষাজীবন ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। মামলা করার পরের বছর ওই কেন্দ্রের শিক্ষক দিয়ে আমাকে সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা দিতে বাধা দেয়া হয়।
কোনো উপায় না পেয়ে রসায়ন পরীক্ষার আগে বিষয়টি ইউএনওকে জানাই। ইউএনও আমাকে পরীক্ষা কেন্দ্রের বারান্দায় একা একটি বেঞ্চে বসিয়ে আলাদা করে পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করেন। ইউএনও পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বারান্দার নিচে বসেছিলেন।
মুস্তারী বলেন, খারাপ শিক্ষার্থী প্রমাণ করার জন্য পরের বারও উত্তরপত্র পরিবর্তন করে দেয়া হয়। ফলে সেবারও আমার ফলাফল খারাপ হয়। কোনো মতে পাস করি আমি।
হতাশ হয়ে উচ্চমাধ্যমিকে মানবিক বিভাগ নিয়ে পড়াশোনা করে এ গ্রেড পেয়ে পাস করি। এসএসসির ফল খারাপ হওয়ায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদনই করতে পারিনি। শেষে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর করেছি।
তিনি আরও বলেন, আমার জীবনের অপূরণীয় ক্ষতি করা হয়েছে। এই আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাই। যাতে আর কোনো শিক্ষার্থীর জীবনে এ অভিশাপ না নামে।
জানতে চাইলে রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের বর্তমান পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আরিফুল ইসলাম বলেন, এটা আমার সময়ে হয়নি। অনেক আগের কথা। ওই সময়কার পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ভালো বলতে পারবেন।
বিবাদীপক্ষের আইনজীবী এজাজুল হক বলেন, আইনি প্রক্রিয়ার ভেতর রয়েছি আমরা। আদালত যে রায় দেবেন, সেটাই আমরা মেনে নেব।